এক.
আমরা যে ছোট্ট কলোনিতে থাকতাম তার শেষ প্রান্তে একটা মস্ত তালগাছ ছিলো। সেই তালগাছটা আছে এখনো। কলোনি ছেড়েছি বছর দশেক হলো কিন্তু তার স্মৃতিটা ছাড়তে পারিনি আজও। এমনও কিছু কিছূ স্মৃতি থাকে যা ভূলে যেতে গিয়ে বারবার মনে পড়ে আর সেই রকম স্মৃতি তুলে যাওয়া কঠিন।
কখনোবা চোখ বন্ধ করলে সেই স্মৃতিগুলো সিনেমার পর্দার মতো ভেসে উঠে মনের কোঠায়। আর তাই কলোনির সেইসব স্মৃতি আমাকে এখনও তাড়িয়ে ফেরে।

কলোনির পাশটায় সবচেয়ে উচু যে বিল্ডিংটা ছিলো সেটা ছিলো রায়দের বাড়ী। লম্বা লোহার গেট,সদৃশ্য বাগান, ভেতরটার আঙ্গিনা জুড়ে সবুজ লম্বা ঘাস। ও বাড়ীর ভেতর কখনো ঢুকতে পারিনি, শুধু বাইরে থেকে দেখেছি ভেতরের দম্ভ ভরা মানুষ গুলোকে। ওরা কাউকে ভিক্ষে পর্যন্ত দিতোনা। কলোনির সবাই ওদের কে সমীহ করে চলতো।
আমার কখনোবা স্বাদ জাগতো একটি বার গিয়ে বসি ভেতরের বাগানটায়; কিংবা সবুজ দুর্বা ঘাসে হাত বুলাই কিন্তু সেইটে যে কপালে নেই তা আমার জানা ছিলো।
কলোনির যে পাশটায় আমরা থাকতাম তার ঠিক উল্টো পাশেই ছিলো দু’তলা একটা বাড়ি। ওটা ছিলো সেন দের বাড়ি। সেন বাড়ীর লোকজনকেও সমীহ করে চলতে হতো কেননা আমরা যে ছিলাম কলোনির অর্থহীন পরিবারদের মধ্যে একজন।

ওই কলোনিতে থাকার সুবাদেই জন্মদিন শব্দটার সাথে কম বয়সেই আমার পরিচয় ঘটেছিলো। সেনদের পরিবারের লোকেরা খুব সৌখিন ছিলো, ওদের টাকা পয়সার কমতি ছিলোনা,তাই অহংকারটা ছিলো ওদের অলংকারের মতো।
আমাদের ভাঙ্গাচোরা আধপাকা ঘরটায় দিনরাত্রী যাপন করতাম সামনে রেখে সেনদের সেই দুর্দান্ত বিল্ডিংটাকে। ওদের বাড়ীতে কোন অনুষ্ঠান হলে ওদের জানালার শিক গলে সেই উৎসবের আমেজ এসে ছিটকে পড়তে আমাদের ভাঙ্গা দেয়ালে।
এমনি এক সন্ধ্যায় ওদের নিচতলার ঘরটায় আলোর ঝলকানি দেখে উকি দিয়েছিলাম। পাশের দেয়ালে রঙ্গিন কাগজে লেখা শুভ জন্মদিন তার পাশে মোম,কেক আর পুরো ঘরটায় চুমকি কাগজে সাজানো ঘরভর্তি লোকারন্য।
আমরা এইসব অনুষ্ঠানের নেমন্তন্ন কখনই পেতাম না। তাই জানালার ফাক দিয়ে লুকিয়ে দেখতে হতো। একবার এইভাবে চুরি করে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম। তারপর ওরা ডেকে এনে অপমান করলো সেই বারান্দা থেকে নেমে আসবার সময় পড়ে গিয়ে সেদিন পা মচকে গেলো। বাড়ি ফিরে সেদিন আমি অনেক কেঁেদেছি; তবে সেটা লুকিয়ে।
সেই বয়সেই কৌতুহল যতটা ছিলো আমার তারচেয়ে অপমান বোধ ছিলো বেশি।
মা বলতো পৃথিবীতে যতো লোকের জন্মদিন পালন করা হয়, তারচেয়ে দিগুন লোকের তো পালন করাই হয়না আর তুই না হয় তাদেরই একজনি হলি।

স্কুলে আমার বন্ধুদের জন্মদিনে দেখতাম ওরা কতো শুভেচ্ছা কার্ড,গিফট পেতো। ওরা বড় কেক কেটে পরিবারের ক’জনের মুখে তুলে দিতো ক্লিক ক্লিক শব্দে ভরা স্ন্যাপ শটে হাসিতে আর গানে ভাসতো ঘর। সে সবের কিছুই হতোনা আমাদের ভাঙ্গা ঘরে, বাবার পকেট তখন গড়ের মাঠের স্থাযী বাসিন্দা। এভাবেই ছোটবেলা থেকেই হারাদের দলে থেকে গেছি।

দুই.

সেদিনের সেই অপমানের পর সেনদের বারান্দার ও মুখো আর হইনি অনেকদিন। আবার একদিন হলাম সেটাও বেশ ক’বছর পরে; এক সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরছি তখন। সেদিন সেনদের পরিবারর সবচেয়ে কনিষ্ঠ কণ্যা নিশি’র জন্মদিনের পার্টি ছিলো। ও আবার আমার সাথেই কলোনির স্কুলে পড়তো সমবয়সি ছিলো। আমাদের চলাচল করতে হতো ওদের বারান্দার সামনের এক চিলতে ছোট্ট রাস্তা দিয়ে। আমি সেই রাস্তা ধরেই ফিরছি হাতে বই, হঠাৎ ওদের বারান্দার পাশ থেকে নিশি’র ডাক শোনা গেল এই সকাল শুনে যা।

এর আগে নিশি ও বারান্দার পাশ থেকে কখনো ডাকেনি প্রথমে ভাবলাম ভুল কিন্তু পরপর বেশ ক’বার ডাক শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে ও ডাকছে।
আমি বরাবরই ওদের ভয় পেতাম তাই সাহস পাচ্ছিলাম না সামনে যাবার। নিশি বের হয়ে এসে বললো আমার বার্থ ডে আজ ভিতরে সবাই এসেছে তুইও আয়। আমি মাথা নিচু করে বললাম না,রে আমার কাজ আছে। ও আবার বললো আয় না।
নিশি তার কিশোরী মাথার বুদ্ধি খাটিয়ে সেদিন বুঝতে পারেনি যে সমাজে ওদের আর আমাদের মাঝে ব্যাবধান একটাই।
ওর দাদু সেদিন চোখ রাঙ্গিয়ে জিঞ্জাস করেছিলো ওকে ডাকছো কেন? নিশি বলেছিলো ও আমার ক্লাসে পড়ে আমার বন্ধু। ওর দাদুর চোখ রাঙ্গানিটা আমার চোখের কান্নাকেও হার মানিয়েছিলো সেদিন।

সেদিন এক দৌড়ে বাসায় ফিরে আবার কাঁদলাম। মা বলল কেন কাদঁছিস আমি সত্যিটা সেদিন বলিনি আজও বলিনি। মা কিছুটা আচঁ করতে পেরেছিলো বোধহয়। তাই বলেছিলো আচ্ছা ঠিক আছে আমরা এবার তোর জন্মদিনেও কেক কাটবো, আমি বললাম সত্যি।
পরদিন সকালে খুব ভোরে মা আমাকে ডেকে তুলে বললো,যা স্নান করে আয় আমি বললাম কেন ? আরে যা আগে স্নান করে আয় তারপর বলছি। স্নান করে এসে দেখি মা ছোট্ট একটা কেক আর মোমবাতি নিয়ে বসে আছে। সেদিন মা,বাবা,ভাইয়া সবাই আমাকে আর্শিবাদ করলো। আমাদের সেই কলোনির ভাঙ্গাঘরটাকেই সেদিন আমার মনে হয়েছিলো সুখের স্বর্গ।

আমি সেদিন আরও হতবাক হয়েছিলাম; সেই সাতসকালে সবাই যখন সবে নিদ্রা দেবীকে আড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছে মাত্র সেই সময়ে হাতে একটা ফুল তোলার ডালি নিয়ে নিশি আমাদের বারান্দায় দাড়িয়ে। আমাকে হাতের ইশারায় ডেকে বললো আজ যে তোর জন্মদিন আমাকে তো বলিস নি। আমি চুপ করে গেলাম। ও আবার বললো কাল দাদুর কথায় কষ্ট পেয়েছিস; প্লিজ সরি; ওসব ভুলে যা।
আমি বললাম ঠিক আছে। নিশি আবার বললো তুই তো আমার জন্মদিনের কেক খাসনি তোর জন্মদিনের কেক আমায় খেতে দিবিনা।
মা ভেতর ঘরে বসেই ছিলো এক হাতে এক টুকরো কেক আর মিষ্টি নিয়ে এলো।
নিশি যাবার আগে বললো বিনা নিমন্ত্রনে তোর জন্মদিন খেয়ে ফেললাম; আমার কাছে তো কিছু নেই এখন কি যে তোকে গিফট দেই; আমি বললাম লাগবে না। আচ্ছা ঠিক আছে বলে ও ফুলের ডালি;খেকে বেশ ক’টা বকুল ফুল দিয়ে বললো আপাতত এই নে।

তিন.

তার পরের বছরেই কলোনি ছেড়েছি। এর মাঝে কতো দিন গড়িয়েছে। কতো কিছু ঘটে গেছে কিন্তু কেক কেটে আর জন্মদিন পালন করা হয়নি আমার।
আমি বড় কোন তারকা,কবি কিংবা শিল্পিী নই যে আমার জন্মদিনে কেউ গ্রেটিংস কার্ড পাঠাবে। আজকাল আমার জন্মদিন পালন করা হয় বাবা মায়ের আর্শিবাদ নিয়ে আর বন্ধুদের মৌখিক শুভেচ্ছা দিয়েই।
হয়তো এভাবেই কাটবে আমার বেচেঁ থাকা দিনের জন্মদিন গুলো।

****************/////////////////////*****************